
আব্দুল কুদ্দুস রানা,প্রখম আলো :: কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের কলাতলী-সুগন্ধা-লাবণী পয়েন্ট পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটারে সারা বছর পর্যটকের সমাগম লেগে থাকে। পিঠে তুলে পর্যটকদের বালুচর ঘোরানোর জন্য ঘোড়া আছে ৫০টির বেশি।
খাবারের সন্ধানে সৈকতে দল বেঁধে বিচরণ করে শত শত বেওয়ারিশ কুকুর। বালুচরে ঘাস না থাকলেও দেখা মেলে অসংখ্য গরুর।
পরিবেশ ও প্রাণী বিশেষজ্ঞদের অভিমত, মানুষ ও পশুর সহাবস্থান জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য যেমন ঝুঁকিপূর্ণ, তেমনি লবণাক্ত আবহাওয়া প্রাণীর জন্যও ক্ষতিকর।
বিশেষ করে ঘোড়ার বিষ্ঠা ও মূত্র বালুচর দূষিত করে, যা ভ্রমণে আসা শিশু-কিশোরদের বিপদ ডেকে আনতে পারে।
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের উপপরিচালক খন্দকার মাহবুব পাশা বলেন, খাবারের সন্ধানে বেওয়ারিশ কুকুর ও গরু সৈকতে নামে। আর পর্যটকদের পিঠে তুলে ঘোরানোর জন্য ঘোড়া রাখা হয়।
প্লাস্টিক, খাবারভর্তি পলিথিন-উচ্ছিষ্ট খায় প্রাণীগুলো।
ক্লান্ত ও অভুক্ত ঘোড়া সমুদ্রের লোনাপানি পান করে, গোসলও লোনাপানিতে। ঘোড়া ও কুকুরের মলমূত্র বালুচর ও পানিতে দূষণ ছড়াচ্ছে।
ঘোড়ার বিষ্ঠা-মলমূত্র বালুচরে পড়ামাত্র সরিয়ে ফেলতে ঘোড়ামালিকদের নির্দেশনা দেওয়া আছে।

অভুক্ত ঘোড়া
গত শুক্রবার দুপুর ১২টা। সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টের বালিয়াড়িতে দাঁড়িয়ে রাখা হয় সাতটি ঘোড়া। পর্যটকেরা ঘোড়াগুলো ঘিরে ছবি তুলছেন। একজন নারী তাঁর দুই শিশুসন্তানকে পিঠে তুলে ঘোড়ায় চড়তে দেন।
ঘোড়াচালক রহিম দুই শিশুকে বালুচর ঘুরিয়ে দিয়ে আনেন। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল, ঘোড়াকে সমুদ্রের পানিতে নিয়ে গোসল করানো হচ্ছে। এ সময় ঘোড়াটি লোনাপানি খাচ্ছিল।
পরিবেশবিষয়ক সংগঠন ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) কক্সবাজারের সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, তিন দশক ধরে সৈকতে ঘোড়ার ব্যবসা চলছে।
সাত বছর আগেও ১২০টির মতো ঘোড়া ছিল, এখন আছে ৫০-৬০টি। সারা দিন ঘোড়াগুলো সৈকতে পর্যটক টানে। এ সময় মলমূত্র ত্যাগ করে। পর্যটকের বিচরণক্ষেত্রে ঘোড়ার বিষ্ঠা ও মূত্র স্বাস্থ্যের ঝুঁকি বাড়ায়।
ঘোড়ার মলমূত্রে ক্ষতিকারক জীবাণু থাকে। ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, ঘোড়াগুলোকে ঠিকমতো খাবারও দেওয়া হয় না। অসুস্থ ও অভুক্ত থেকে গত পাঁচ বছরে অন্তত ৫০টি ঘোড়ার মৃত্যু হয়েছে।
ঘোড়ার বিষ্ঠা সমুদ্রের পানিতে মিশে যায়। সেই পানিতে গোসল করেন হাজার হাজার মানুষ।
এক দশক আগে স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি মাথায় রেখে তৎকালীন জেলা পুলিশ সুপার সেলিম মো. জাহাঙ্গীর ঘোড়ার ব্যবসা বন্ধ রেখেছিলেন। দুই বছর পর আবার ঘোড়ার ব্যবসা শুরু হয়।
কক্সবাজার ঘোড়া মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আহসান উল্লাহ নিশান প্রথম আলোকে বলেন, সমিতির আওতায় ৪২ জনের বর্তমানে ৫৫টি ঘোড়া রয়েছে।
সকাল সাতটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘোড়াগুলো সৈকতে পর্যটকদের বিনোদন দেয়। আগে ঘোড়াদের সমুদ্রের লোনাপানি খাওয়ানো হতো। এখন ভুসির সঙ্গে লবণ মিশিয়ে খাওয়ানো হয়।
ঘোড়ার বিষ্ঠা-মূত্র যেন বালুচর কিংবা সমুদ্রের পানিতে না ছড়ায়, সে জন্য বালুর নিচে পুঁতে ফেলা হয়। আগে প্রতিবছর অসুস্থ হয়ে ১০-১২টা ঘোড়া মারা যেত। এখন ২-৩টা।
অধিকাংশ ঘোড়া চর্মরোগে আক্রান্ত কেন, জানতে চাইলে আহসান উল্লাহ বলেন, সমুদ্রের লবণাক্ত আবহাওয়াতে ঘোড়ার চর্মরোগ হয়, লোম উঠে যায়। আবার বর্ষাকালে সারা দিন বৃষ্টিতে ভিজে। কিছু মালিক ঘোড়াকে ঠিকমতো খাবার দেন না, এ কারণে কিছু ঘোড়া অপুষ্টিতে ভোগে দুর্বল হয়।

কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি আয়াছুর রহমান বলেন, পর্যটন মৌসুমে যখন সমুদ্রসৈকত লাখো পর্যটকে ভরপুর থাকে, তখন প্রতিটি ঘোড়া থেকে মালিকপক্ষ আয় করে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা।
আয়রোজগার কমে গেলে ঘোড়াগুলোকে খাবার না দিয়ে রাস্তাঘাটে ছেড়ে দেওয়া হয়। তখন অভুক্ত ঘোড়া লোনাপানি, পলিথিন খেয়ে ফেলে।
ঘোড়াচালকদের বেশির ভাগ শিশু–কিশোর। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কিশোর চালক জানায়, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘোড়াগুলো সৈকতে পর্যটক টানে, অথচ এ সময়টুকুতে ঘোড়াদের কিছুই খেতে দেওয়া হয় না। সকাল ও সন্ধ্যায় বাড়িতে খাবার খাওয়ানো হয়।
দুর্বল, অসুস্থ বা আঘাতপ্রাপ্ত ঘোড়ার পিঠে চড়া একেবারেই অনুচিত উল্লেখ করে কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা বলেন, এটি ঘোড়ার প্রতি নিষ্ঠুরতাও বটে। বালুচরের যেখানে ঘোড়ার বিচরণ, সেদিকে হাঁটাচলা কিংবা শিশুদের খেলতে দেওয়া অনুচিত।
সারা দিন ঘোড়া মলমূত্র ত্যাগ করতে থাকে উল্লেখ করে রামু উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. অসীম বরণ সেন বলেন, ঘোড়াকে প্রচুর খাওয়াতে হয়।
ঘোড়ার বিষ্ঠা ও মূত্রতে ক্ষতিকর জীবাণু থাকলেও স্বাস্থ্যগত তেমন ঝুঁকি নেই। কারণ, বিশাল সৈকতে অল্পসংখ্যক ঘোড়া একসঙ্গে থাকে। তবে ঘোড়াকে লোনাপানি খাওয়ানো একেবারে অনুচিত। লোনা আবহাওয়া ঘোড়ার চর্ম রোগ হয়।
বেওয়ারিশ কুকুর ও গরুর বিচরণক্ষেত্র
সৈকতজুড়ে বেওয়ারিশ কুকুরের বিচরণ পর্যটকদের মধ্যে চরম আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। কিছু অভুক্ত কুকুর খাবারের জন্য শিশু-কিশোরদের পিছু নেয়। মাঝেমধ্যে নারী শিশুদের আক্রমণও করে বসে।
কুমিল্লার পর্যটক শামসুল হুদা বলেন, কুকুরের কামড় আতঙ্কে শিশুদের বালুচরে ছেড়ে দেওয়া যায় না।
কারণ, কুকুর কামড়ালে কিংবা আঁচড় দিলে জলাতঙ্ক ছড়াতে পারে। তা ছাড়া কুকুরের মল সৈকতের বালুকে দূষিত করছে, যা থেকে শিশুদের মধ্যে পরজীবী সংক্রমণ ও চর্মরোগ ছড়াতে পারে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লাইফগার্ডের একজন সদস্য বলেন, সকাল ছয়টা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত শত শত কুকুর সৈকতে পড়ে থাকে এবং খাবারের সন্ধান করে।
শীত মৌসুমে কুকুরের দল সামুদ্রিক কচ্ছপের ডিম ও লাল কাঁকড়া খেয়ে ফেলে, যা সৈকতের জীববৈচিত্র্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
প্রাণী চিকিৎসকেরা বলেন, কুকুর জলাতঙ্ক ভাইরাসের প্রধান বাহক। বেওয়ারিশ কুকুরের কামড় বা আঁচড়ে জলাতঙ্ক হতে পারে। এই রোগে আক্রান্ত মানুষের মৃত্যু প্রায় অনিবার্য।
পর্যটন এলাকায় শিশুরা এর প্রধান শিকার হতে পারে। কুকুরের মলমূত্র সৈকতের বালুচরে মিশে যায়। তাতে পরজীবী ও ব্যাকটেরিয়া জীবাণুর সংক্রমণ হতে পারে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক খন্দকার মাহবুব পাশা বলেন, আগে বেওয়ারিশ কুকুর নিধনের মাধ্যমে সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা হলেও, ২০১২ সালে হাইকোর্টের এক নির্দেশনায় নির্বিচার কুকুর নিধন বন্ধ করা হয়।
এর বিকল্প হিসেবে সরকার কুকুরকে বন্ধ্যাকরণ এবং টিকাদান কর্মসূচির ওপর জোর দিয়েছে, যা মানবিক ও পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি। কিন্তু কক্সবাজার সৈকতের মতো বিশাল এলাকায় সেই কর্মসূচি পুরোপুরি কার্যকর না হওয়ায় বেওয়ারিশ কুকুরের সংখ্যা বাড়ছে।
এদিকে সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে গরুর বিচরণও চোখে পড়ে। বালুচরের যত্রতত্র গরুর মল পড়ে থাকতে দেখা যায়।
বালুচরে ঘাস নেই, তবু কেন গরু দল বেঁধে সৈকতে নামে জানতে চাইলে প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. অসীম বরণ সেন বলেন, গরমের সময় সমুদ্রসৈকত তুলনামূলকভাবে শীতল পরিবেশ এবং মৃদু বাতাস থাকে, যা প্রাণীগুলোকে কিছুটা আরাম দেয়। আরামদায়ক জায়গা হিসেবে গরু সৈকতের খোলামেলা, প্রশস্ত বালিয়াড়ি বেছে নিতে পারে।
খাদ্যের সন্ধানেও নামতে পারে। সৈকত লাগোয়া হোটেল, মোটেল এবং খাবারের দোকানগুলো থেকে বিভিন্ন ধরনের উচ্ছিষ্ট খাবার, পচা-বাসি খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য বর্জ্য সৈকতের উন্মুক্ত স্থানে বা আশপাশে ফেলা হয়।
তবে গরুর মলমূত্র পড়ে থাকলে দুর্গন্ধ ছড়ায়, পরিবেশ নষ্ট করে, কিন্তু স্বাস্থ্যের জন্য তেমন ঝুঁকি না। গরুর মল দিয়ে জৈব সার ও বায়োগ্যাস উৎপাদন হয়।
প্রাণী চিকিৎসক ও পরিবেশবিজ্ঞানীরা বলছেন, সমুদ্রসৈকতের লোনা আবহাওয়া বা সামুদ্রিক বাতাস গরু বা ঘোড়ার জন্য দীর্ঘ মেয়াদে ঝুঁকি বাড়াতে পারে। সমুদ্রের লোনা বাতাসে সামান্য পরিমাণে লবণ থাকে।
মানুষের ক্ষেত্রে এই লবণ শ্বাসতন্ত্রের জন্য উপকারী হলেও প্রাণীর ক্ষেত্রে এই লবণের কণা শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে প্রবেশ করে দীর্ঘ মেয়াদে হালকা জ্বালা বা সংবেদনশীলতা সৃষ্টি করতে পারে। নোনা বাতাস এবং লোনাপানি প্রাণিদেহের ত্বক এবং লোমকে শুষ্ক করে দিতে পারে।
সমুদ্রের লোনা জল গরু বা ঘোড়ার জন্য একেবারেই পানযোগ্য নয়। লোনা জল পান করলে প্রাণী পানিশূন্যতা (পানিশূন্যতা), কিডনির সমস্যা এবং লবণ বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে।
প্লাস্টিক, পলিথিন, বর্জ্য গবাদিপশুদের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। গরু বা ঘোড়া এগুলো খেয়ে ফেললে পরিপাকতন্ত্রে বড় ধরনের জটিলতা তৈরি হতে পারে, যা মৃত্যুর কারণও হতে পারে।
অন্যদিকে সমুদ্রসৈকত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং পরিবেশের কারণে মানুষের স্বাস্থ্য ও মানসিক শান্তির জন্য খুবই উপকারী।
সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ শোনা, সূর্যাস্ত দেখা বা সমুদ্রের ধারে হেঁটে বেড়ানো মনকে শান্ত করতে এবং মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে।
এটি মানসিক শান্তি ও বিশ্রামের জন্য একটি আদর্শ স্থান। নোনাপানি মানুষের ত্বককে পুষ্ট করতে পারে এবং ত্বকের মৃত কোষ ঝরিয়ে ত্বক ভালো রাখতে সাহায্য করে।


Posted ১১:৫০ পূর্বাহ্ণ | সোমবার, ০৩ নভেম্বর ২০২৫
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta